ঢাকা ০৬:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাধবপুরে এক নারীর কাছে চার পুরুষ বন্দি! জমি বিক্রির নামে প্রতারণার অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার::
  • নিউজ প্রকাশের সময় : ০৬:১৬:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৩ ১৬৭ বার পড়া হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার:: হবিগঞ্জের মাধবপুরে সম্পত্তি ক্রয়ের রেজিস্ট্রি দলিল করে প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছে এক শিল্পপতিসহ ৩ ব্যবসায়ী। জমি বিক্রি করে দলিল দেয়ার পরও সাজানো এক মিথ্যে মামলা দিয়ে আপোষনামার কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছে ১কোটি টাকা। প্রতারক চক্রটি একের পর এক চক্রান্তে লিপ্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীনসহ প্রতারক চক্রের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকে শিল্পপতিসহ ৩ ব্যবসায়িক পরিবারটি চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ প্রতারক চক্রের হোতা মাধপুর উপজেলার ১১নং বাঘাসুরা ইউনিয়নের হরিতলা গ্রামের মৃত হাফিজ উল্লাহর স্ত্রী নুরজাহান বেগম (৬৫) ও তার তিন ছেলে বাবুল মিয়া (৪৫), আবুল মিয়া (৩৮) এবং কাশেম মিয়া (২৮)।

জানাযায়, ওই এলাকায় বিভিন্ন কোম্পানী গড়ে উঠলে জমি ক্রয় বিক্রয়ের হিড়িক পড়ে। ২০১৬ সালে নুরজাহান বেগম তার ১৩৭৯ খতিয়ানের ২৫৮শতক জমি বিক্রয় করার জন্য কুলটেক সলিউশন লিমিটেড এর প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম জিয়ার সাথে যোগাযোগ করে। একপর্যায় ‍উভয়পক্ষের মধ্যে জমির দরদাম ঠিক হলে নুরজাহানের ২৫৮ শতক জমি ৩কোটি ৭৫লাখ টাকায় কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে কুলটেক সলিউশন লিমিটেড এর চেয়ারম্যান আব্বাসী আদম আলী। ওই সময়ে ২৫৮ শতক জমির মধ্যে ১৭৮ শতক জমি কোম্পানীর নামে সাব কবলা দলিল করে দেন নুরজাহান বেগম। বাকি ৮০ শতক জমি বায়না করা হয়। কিন্তু কোম্পানীর প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম জিয়া ওই সময় ৪০ লাখ টাকা নগদ প্রদান করে এবং বাকি ৩কোটি ২৫ লাখ টাকার ৬টি চেক প্রদান করেন। সেই সাথে ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর জুডিমিয়াল স্ট্যাম্পে একটি অঙ্গিকারনামা করেন জিয়া ও নুরজাহান বেগম। পরবর্তীতে উক্ত চেকগুলো টাকা উত্তোলন করতে না পেরে আরিফুল ইসলাম জিয়ার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তালবাহানা করতে থাকেন। নুরজাহান বেগম ‍উক্ত টাকা না পেয়ে ৬টি চেকের মধ্যে একটি চেক ডিজঅনার করে গত বছরের ১২ মে হবিগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি সিআর মামলা করেন। মামলা নং ২২৬/২২। উক্ত মামলা করার পর ওই বছরের ১২জুন ৪জনকে আসামী করে আরেকটি মামলা করে নুরজাহান বেগম। ওই মামলাটি আদালত আমলে নিয়ে ৪জনের নামে এজাহারভুক্ত করার জন্য মাধবপুর থানাকে আদেশ দেয়া হয়। মামলার আসামীগণ হলেন-কুলটেক সলিউশন লিমিটেড এর চেয়ারম্যান আব্বাসী আদম আলী, কোম্পানীর প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম জিয়া, চারাভাঙ্গা সাব রেজিস্ট্রার অফিসের সাবেক দলিল লেখক সালাহউদ্দিন ও এক্তিয়ারপুর গ্রামের পল্লীচিকিৎসক শাহ আলম। উক্ত বিষয়ে মানববন্ধন হলে বিভিন্ন স্থানীয়-জাতীয় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় বেশকিছু সংবাদ প্রকাশ করা হয়।

মামলার বিবরণ থেকে আরও জানাযায়, বাদীনি নুরজাহান বেগমের সাথে প্রথম ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট। তার জমি কোম্পানীকে দলিল করে দেয়ার পর আরিফুল ইসলাম জিয়া ৬টি চেকের মাধ্যমে টাকা দিতে তাল বাহানা করলে আদালতে জিয়ার নামে ১কোটি টাকার একটি চেক ডিজঅনার মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়ের করার পর ৩কোটি ২৫লাখ টাকা নগদ দেয়ার কথা বলে ৪নং আসামী শাহ আলমের মাধ্যমে কোম্পানীর চেয়ারম্যান ১নং আসামী আব্বাসী আদম আলী ও আরিফুল ইসলাম জিয়া বাদীনি ও তার সন্তানদের ঢেকে নিয়ে গত বছরের ২৭মে নোয়াপাড়া ছাগল হাটার পশ্চিম দিকে ৩নং আসামী দলিল লেখক সালাহ উদ্দিনের অফিসে ছুরি ও পিস্তলের মুখে জিম্মি করে নুরজাহান ও তার সন্তানদের কাছ থেকে জোড়পূর্বকভাবে ৫টি চেক ও  ২০ থেকে ২৫টি ১০০ টাকার খালি জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখেন। এবং তাদেরকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন। এবিষয়ে সঠিক বিচার চেয়ে অজ্ঞাত ৪জনসহ ৪জনের নামে আদালতে আরেকটি মামলা দায়ের করেন নুরজাহান বেগম। মামলা নং ২৭৭/২২

নুরজাহান বেগম মামলা দায়ের করার ১মাস পর (২৭জুন-২২) কুলটেক সলিউশন লিমিটেড এর চেয়ারম্যান আব্বাসী আদম আলীর সাথে ১কোটি টাকার বিনিময়ে আপোষ করেন। যদিও বর্তমানে মামলাটি আদালতে চলমান রয়েছে।

আমাদের অনুসন্ধানে জানাযায়, কুলটেক সলিউশন লিমিটেড এর চেয়ারম্যানসহ ৪জনের নামে দায়েকৃত নুরজাহান বেগমের ২৭৭নং মামলাটি মিথ্যে ও সাজানো। মামলায় উল্লেখ করা হয় ২০২২ সালের ২৭ মে বাদীনি ও তার সন্তানদের ঢেকে নিয়ে নোয়াপাড়া ছাগল হাটার পশ্চিম দিকে ৩নং আসামী দলিল লেখক সালাহ উদ্দিনের অফিসে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চেক ছিনিয়ে নেয় এবং ২০ থেকে ২৫টি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখা হয়। ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয় বিকাল ৩টায়। অতচ ওইদিন এ ধরণের কোন ঘটনাই ঘটেনি। আশপাশের দোকানপাট ও স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে তারা এধরনের ঘটনার কোন খবর বলতে পারেনি। তাছাড়া আশপাশে ওই তারিখে থাকা সিসি ক্যামেরা অনুসন্ধান করেও কোন ফুটেজ পাওয়া যায়নি। মামলায় বলা হয় ৪নং আসামী শাহআলমের যোগসাজেসে ওই তারিখে বাদীনি ও তার সন্তানদের নিয়ে ঘটনার দিন যাওয়া হয়। অতচ ঘটনার আগে-পরে শাহআলমের কল লিস্ট এবং বাদীনির তিন সন্তানদের কললিস্টেও যোগসাজের কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। ঘটনার আগে পরে উভয়ের সাথে কোন কথোপকথন হয়নি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- মামলায় উল্লেখ করা হয় দলিল লেখক সালাহ উদ্দিনের অফিসে ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালের ২৭মে। আর অফিসটি সালাহউদ্দিন ছেড়ে দেন ২০২০সালের মাঝামাঝি সময়ে। অর্থাৎ ঘটনা ঘটার দুই বছর আগেই দলিল লেখক সালাহউদ্দিন অফিস ছেড়ে চলে যান। যা অফিসের মালিককে জিজ্ঞেস করলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। বিষয়টি দলিল লেখক সালাহ উদ্দিন অফিস ছাড়ার ব্যাপারে আমাদের নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, আমি ২০০৯সালে অফিসটি ভাড়া নেই, আর ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ছেড়ে দেই। এতেই বুঝাযায় বাদীনির মামলাটি মিথ্যে-সাজানো এবং পূর্ব পরিকল্পিত।

মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, বাদীনি তার ২৫৮ শতক জমি বিক্রি করেন ৩কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এরমধ্যে ১৭৮ শতক জমি দলিল করা হয় এবং বাকি ৮০ শতক জমি বায়না করা হয়। টাকা ছাড়া বাদীনি কিভাবে ৩কোটি ৭৫ লাখ টাকার সম্পত্তি দলিল করে দেয় এপ্রশ্নও থেকে যায়। বাদীনির সাথে আসামী আরিফুল ইসলাম জিয়ার সাথে যে অঙ্গিকারনামার কথা বলা হয়েছে সেটিও মিথ্যে বানোয়াট। কারণ বাদীনি তার মামলায় একটি বিষয় গোপন রেখেছেন। ২৫৮ শতকের মধ্যে ১৭৮ শতক জমি দলিল করা হলেও ৮০শতক জমি বায়নার কথা উল্লেখ করেছেন। এই ৮০শতক কবে কখন দলিল করা হয়েছে তা বাদীনি তার মামলায় উল্লেখ করেননি। আমাদের হাতে আসা তথ্যমতে বাদীনি বায়নাকৃত ৮০শতক জমির মধ্যে ৪৭শতক জমি ২০২১ সালে কোম্পানীর নামে দলিল করে দেন। যা বাদীনি তার মামলায় গোপন রেখেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে বাদীনি যদি পূর্বে টাকা না পেয়ে থাকে তাহলে বাকী ৮০শতকের মধ্যে ৪৭ শতক জমি কিভাবে দলিল করে দেন। কার কথায় দলিল করেছেন, কেন করেছেন? কোন ভরসায়? যেখানে দলিলকৃত ১৭৮ শতকের টাকাই বাদীনি বুঝে পাননি সেখানে ৮০শতকের মধ্যে ৪৭ শতক জমি পুনরায় কিভাবে টাকা ছাড়া দলিল দেন? ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর তারিখে যে অঙ্গিকার নামা হয়েছে উক্ত অঙ্গিকার নামা কেন পরিবর্তন হয়নি এবং ২০১৬ সালের দেয়া ব্যাংক চেকও পরিবর্তন হওয়ার কথা। কিন্তু কোনটাই হয়নি। বায়নাকৃত ৮০ শতকের মধ্যে ৪৭ শতক জমি ২০২১সালে দলিল হলে অঙ্গিকার নামা পরিবর্তন হওয়ার কথা। কারন ওই অঙ্গিকার নামায় বায়নার কথা উল্লেখ আছে, দলিলের কথা নয়, তাহলে কি বাদী আবারও ৮০শতক দলিল করে দিবেন?

মামলায় আরও বলা হয়েছে, ২০ থেকে ২৫টি খালি জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে তাদের স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাদীনি এতবড় হুমকির মুখে পড়ার পরও কেন তাদের নামে থানায় কোন জিডি করেননি। মামলা করার পরও ওই স্ট্যাম্প, পিস্তল ছুরি আজও কেন উদ্ধার করা হয়নি।

বাদীনি নুরজাহান বেগম ৬টি চেকের মধ্যে প্রথমে ১টি চেকের মামলা করেন আদালতে। টাকা উল্লেখ করেন ১কোটি। কিন্তু বাদীনি টাকা পাবে ৩কোটি ২৫ লাখ। প্রশ্ন হচ্ছে বাদীনির সাথে ৬টি চেক থাকা সত্ত্বেও ৩ কোটি ২৫লাখ টাকার মামলা না করে ১টি চেকে ১ কোটি টাকার মামলা করার রহস্য কি? আদৌ কি বাদীনির কাছে ৬টি চেক ছিলো? তাছাড়া ২০১৬ সালে দেয়া চেক ২০২২ সালে এসে কেন মামলা করলেন?

আরিফুল ইসলাম জিয়ার সাথে ১০০ টাকার জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে যে অঙ্গিকারনামার কথা বাদীনি তার মামলায় উল্লেখ করেছেন ওই অঙ্গিকার নামার স্বাক্ষর দলিল লেখক সালাহ উদ্দিনের নয় বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, এধরনের কোন ঘটনা আমার অফিসে ঘটেনি। ওই স্ট্যম্পের স্বাক্ষর আমার নয়, এটা কেউ নকল করেছে। আমি আদালতে আবেদন করেছি, স্বাক্ষর এক্সপার্টে দেয়ার জন্য। আশা করি ন্যায় বিচার পাবো।

এবিষয়ে মামলার ২নং আসামী আরিফুল ইসলাম জিয়ার মুঠোফোনে বার ফোন দেয়ার পরও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার মতামত নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে মামলার অপর আসামী শাহআলম জানান, এই মামলাটি একটি মিথ্যে মামলা। এ বিষয় তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় এগোতে চাইছেন বলে জানান।

মূল ঘটনা: বাদীনি নুরজহান বেগম কুলটেক সলিউশন লিমিটেড কোম্পানীর নিকট ২৫৮ শতক ভুমি ৩কোটি ৭৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। ওই সময় ১৭৮ শতক ভুমি দলিল করে দেন এবং ৮০ শতক ভূমি বায়না করা হয়। এর বাবদ বাদীনি নুরজাহান বেগম আরিফুল ইসলাম জিয়ার কাছ থেকে ২কোটি ৭৫ লাখ টাকা নগদ ‍বুঝে নেন। বাকী ৮০ শতক ভুমি বাবদ আরিফুল ইসলাম জিয়া কোম্পানীর পক্ষে নিজ নামের ৬টি চেক হস্তান্তর করেন। ২০২১সালে ওই ৮০ শতক ভূমি দলিল নেয়ার কথা থাকলে ওই সময় ৮০ শতকের মধ্যে ৪৭ শতক দলিল হওয়ায় নগদ ৫০ লাখ টাকা বাদীনি নুরজাহান বেগমকে আরিফুল ইসলাম জিয়া নগদ বুঝিয়ে দিয়ে ৬টি চেক ফেরত নেন এবং বাকি ৩৩ শতক দলিল দিয়ে ৫০লাখ টাকা নেয়ার কথা বলা হয়। ওই সময় বাকি ৩৩শতকের জন্য আরিফুল ইসলাম জিয়া আরও ৫০ লাখ টাকার আরেকটি ব্ল্যাক চেক দেন। দলিল না হওয়ায় বাদীনি ও তার ছেলেরা টাকা না পেয়ে নিয়মিত জিয়াকে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। তাদের ভয়ে আরিফুল ইসলাম জিয়া ওই এলাকায় আসতে পারেনি। পরবর্তীতে বাদীনি ওই চেকে ১কোটি টাকা বসিয়ে একটি চেক ডিজঅনার মামলা এবং অপরটি ৩কোটি ৪০ লাখ টাকা চেয়ে চারজনের নামে মামলা দায়ের করেন। আর এই মামলার ভয় দেখিয়ে কোম্পানীর সাথে আপোষের নামে ১কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। বাকী আসামীদের সাথেও আপোষের নামে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে বলে উভিযোগ রয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

মাধবপুরে এক নারীর কাছে চার পুরুষ বন্দি! জমি বিক্রির নামে প্রতারণার অভিযোগ

নিউজ প্রকাশের সময় : ০৬:১৬:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৩

স্টাফ রিপোর্টার:: হবিগঞ্জের মাধবপুরে সম্পত্তি ক্রয়ের রেজিস্ট্রি দলিল করে প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছে এক শিল্পপতিসহ ৩ ব্যবসায়ী। জমি বিক্রি করে দলিল দেয়ার পরও সাজানো এক মিথ্যে মামলা দিয়ে আপোষনামার কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছে ১কোটি টাকা। প্রতারক চক্রটি একের পর এক চক্রান্তে লিপ্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীনসহ প্রতারক চক্রের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকে শিল্পপতিসহ ৩ ব্যবসায়িক পরিবারটি চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ প্রতারক চক্রের হোতা মাধপুর উপজেলার ১১নং বাঘাসুরা ইউনিয়নের হরিতলা গ্রামের মৃত হাফিজ উল্লাহর স্ত্রী নুরজাহান বেগম (৬৫) ও তার তিন ছেলে বাবুল মিয়া (৪৫), আবুল মিয়া (৩৮) এবং কাশেম মিয়া (২৮)।

জানাযায়, ওই এলাকায় বিভিন্ন কোম্পানী গড়ে উঠলে জমি ক্রয় বিক্রয়ের হিড়িক পড়ে। ২০১৬ সালে নুরজাহান বেগম তার ১৩৭৯ খতিয়ানের ২৫৮শতক জমি বিক্রয় করার জন্য কুলটেক সলিউশন লিমিটেড এর প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম জিয়ার সাথে যোগাযোগ করে। একপর্যায় ‍উভয়পক্ষের মধ্যে জমির দরদাম ঠিক হলে নুরজাহানের ২৫৮ শতক জমি ৩কোটি ৭৫লাখ টাকায় কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে কুলটেক সলিউশন লিমিটেড এর চেয়ারম্যান আব্বাসী আদম আলী। ওই সময়ে ২৫৮ শতক জমির মধ্যে ১৭৮ শতক জমি কোম্পানীর নামে সাব কবলা দলিল করে দেন নুরজাহান বেগম। বাকি ৮০ শতক জমি বায়না করা হয়। কিন্তু কোম্পানীর প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম জিয়া ওই সময় ৪০ লাখ টাকা নগদ প্রদান করে এবং বাকি ৩কোটি ২৫ লাখ টাকার ৬টি চেক প্রদান করেন। সেই সাথে ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর জুডিমিয়াল স্ট্যাম্পে একটি অঙ্গিকারনামা করেন জিয়া ও নুরজাহান বেগম। পরবর্তীতে উক্ত চেকগুলো টাকা উত্তোলন করতে না পেরে আরিফুল ইসলাম জিয়ার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তালবাহানা করতে থাকেন। নুরজাহান বেগম ‍উক্ত টাকা না পেয়ে ৬টি চেকের মধ্যে একটি চেক ডিজঅনার করে গত বছরের ১২ মে হবিগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি সিআর মামলা করেন। মামলা নং ২২৬/২২। উক্ত মামলা করার পর ওই বছরের ১২জুন ৪জনকে আসামী করে আরেকটি মামলা করে নুরজাহান বেগম। ওই মামলাটি আদালত আমলে নিয়ে ৪জনের নামে এজাহারভুক্ত করার জন্য মাধবপুর থানাকে আদেশ দেয়া হয়। মামলার আসামীগণ হলেন-কুলটেক সলিউশন লিমিটেড এর চেয়ারম্যান আব্বাসী আদম আলী, কোম্পানীর প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম জিয়া, চারাভাঙ্গা সাব রেজিস্ট্রার অফিসের সাবেক দলিল লেখক সালাহউদ্দিন ও এক্তিয়ারপুর গ্রামের পল্লীচিকিৎসক শাহ আলম। উক্ত বিষয়ে মানববন্ধন হলে বিভিন্ন স্থানীয়-জাতীয় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় বেশকিছু সংবাদ প্রকাশ করা হয়।

মামলার বিবরণ থেকে আরও জানাযায়, বাদীনি নুরজাহান বেগমের সাথে প্রথম ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট। তার জমি কোম্পানীকে দলিল করে দেয়ার পর আরিফুল ইসলাম জিয়া ৬টি চেকের মাধ্যমে টাকা দিতে তাল বাহানা করলে আদালতে জিয়ার নামে ১কোটি টাকার একটি চেক ডিজঅনার মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়ের করার পর ৩কোটি ২৫লাখ টাকা নগদ দেয়ার কথা বলে ৪নং আসামী শাহ আলমের মাধ্যমে কোম্পানীর চেয়ারম্যান ১নং আসামী আব্বাসী আদম আলী ও আরিফুল ইসলাম জিয়া বাদীনি ও তার সন্তানদের ঢেকে নিয়ে গত বছরের ২৭মে নোয়াপাড়া ছাগল হাটার পশ্চিম দিকে ৩নং আসামী দলিল লেখক সালাহ উদ্দিনের অফিসে ছুরি ও পিস্তলের মুখে জিম্মি করে নুরজাহান ও তার সন্তানদের কাছ থেকে জোড়পূর্বকভাবে ৫টি চেক ও  ২০ থেকে ২৫টি ১০০ টাকার খালি জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখেন। এবং তাদেরকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন। এবিষয়ে সঠিক বিচার চেয়ে অজ্ঞাত ৪জনসহ ৪জনের নামে আদালতে আরেকটি মামলা দায়ের করেন নুরজাহান বেগম। মামলা নং ২৭৭/২২

নুরজাহান বেগম মামলা দায়ের করার ১মাস পর (২৭জুন-২২) কুলটেক সলিউশন লিমিটেড এর চেয়ারম্যান আব্বাসী আদম আলীর সাথে ১কোটি টাকার বিনিময়ে আপোষ করেন। যদিও বর্তমানে মামলাটি আদালতে চলমান রয়েছে।

আমাদের অনুসন্ধানে জানাযায়, কুলটেক সলিউশন লিমিটেড এর চেয়ারম্যানসহ ৪জনের নামে দায়েকৃত নুরজাহান বেগমের ২৭৭নং মামলাটি মিথ্যে ও সাজানো। মামলায় উল্লেখ করা হয় ২০২২ সালের ২৭ মে বাদীনি ও তার সন্তানদের ঢেকে নিয়ে নোয়াপাড়া ছাগল হাটার পশ্চিম দিকে ৩নং আসামী দলিল লেখক সালাহ উদ্দিনের অফিসে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চেক ছিনিয়ে নেয় এবং ২০ থেকে ২৫টি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখা হয়। ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয় বিকাল ৩টায়। অতচ ওইদিন এ ধরণের কোন ঘটনাই ঘটেনি। আশপাশের দোকানপাট ও স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে তারা এধরনের ঘটনার কোন খবর বলতে পারেনি। তাছাড়া আশপাশে ওই তারিখে থাকা সিসি ক্যামেরা অনুসন্ধান করেও কোন ফুটেজ পাওয়া যায়নি। মামলায় বলা হয় ৪নং আসামী শাহআলমের যোগসাজেসে ওই তারিখে বাদীনি ও তার সন্তানদের নিয়ে ঘটনার দিন যাওয়া হয়। অতচ ঘটনার আগে-পরে শাহআলমের কল লিস্ট এবং বাদীনির তিন সন্তানদের কললিস্টেও যোগসাজের কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। ঘটনার আগে পরে উভয়ের সাথে কোন কথোপকথন হয়নি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- মামলায় উল্লেখ করা হয় দলিল লেখক সালাহ উদ্দিনের অফিসে ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালের ২৭মে। আর অফিসটি সালাহউদ্দিন ছেড়ে দেন ২০২০সালের মাঝামাঝি সময়ে। অর্থাৎ ঘটনা ঘটার দুই বছর আগেই দলিল লেখক সালাহউদ্দিন অফিস ছেড়ে চলে যান। যা অফিসের মালিককে জিজ্ঞেস করলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। বিষয়টি দলিল লেখক সালাহ উদ্দিন অফিস ছাড়ার ব্যাপারে আমাদের নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, আমি ২০০৯সালে অফিসটি ভাড়া নেই, আর ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ছেড়ে দেই। এতেই বুঝাযায় বাদীনির মামলাটি মিথ্যে-সাজানো এবং পূর্ব পরিকল্পিত।

মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, বাদীনি তার ২৫৮ শতক জমি বিক্রি করেন ৩কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এরমধ্যে ১৭৮ শতক জমি দলিল করা হয় এবং বাকি ৮০ শতক জমি বায়না করা হয়। টাকা ছাড়া বাদীনি কিভাবে ৩কোটি ৭৫ লাখ টাকার সম্পত্তি দলিল করে দেয় এপ্রশ্নও থেকে যায়। বাদীনির সাথে আসামী আরিফুল ইসলাম জিয়ার সাথে যে অঙ্গিকারনামার কথা বলা হয়েছে সেটিও মিথ্যে বানোয়াট। কারণ বাদীনি তার মামলায় একটি বিষয় গোপন রেখেছেন। ২৫৮ শতকের মধ্যে ১৭৮ শতক জমি দলিল করা হলেও ৮০শতক জমি বায়নার কথা উল্লেখ করেছেন। এই ৮০শতক কবে কখন দলিল করা হয়েছে তা বাদীনি তার মামলায় উল্লেখ করেননি। আমাদের হাতে আসা তথ্যমতে বাদীনি বায়নাকৃত ৮০শতক জমির মধ্যে ৪৭শতক জমি ২০২১ সালে কোম্পানীর নামে দলিল করে দেন। যা বাদীনি তার মামলায় গোপন রেখেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে বাদীনি যদি পূর্বে টাকা না পেয়ে থাকে তাহলে বাকী ৮০শতকের মধ্যে ৪৭ শতক জমি কিভাবে দলিল করে দেন। কার কথায় দলিল করেছেন, কেন করেছেন? কোন ভরসায়? যেখানে দলিলকৃত ১৭৮ শতকের টাকাই বাদীনি বুঝে পাননি সেখানে ৮০শতকের মধ্যে ৪৭ শতক জমি পুনরায় কিভাবে টাকা ছাড়া দলিল দেন? ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর তারিখে যে অঙ্গিকার নামা হয়েছে উক্ত অঙ্গিকার নামা কেন পরিবর্তন হয়নি এবং ২০১৬ সালের দেয়া ব্যাংক চেকও পরিবর্তন হওয়ার কথা। কিন্তু কোনটাই হয়নি। বায়নাকৃত ৮০ শতকের মধ্যে ৪৭ শতক জমি ২০২১সালে দলিল হলে অঙ্গিকার নামা পরিবর্তন হওয়ার কথা। কারন ওই অঙ্গিকার নামায় বায়নার কথা উল্লেখ আছে, দলিলের কথা নয়, তাহলে কি বাদী আবারও ৮০শতক দলিল করে দিবেন?

মামলায় আরও বলা হয়েছে, ২০ থেকে ২৫টি খালি জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে তাদের স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাদীনি এতবড় হুমকির মুখে পড়ার পরও কেন তাদের নামে থানায় কোন জিডি করেননি। মামলা করার পরও ওই স্ট্যাম্প, পিস্তল ছুরি আজও কেন উদ্ধার করা হয়নি।

বাদীনি নুরজাহান বেগম ৬টি চেকের মধ্যে প্রথমে ১টি চেকের মামলা করেন আদালতে। টাকা উল্লেখ করেন ১কোটি। কিন্তু বাদীনি টাকা পাবে ৩কোটি ২৫ লাখ। প্রশ্ন হচ্ছে বাদীনির সাথে ৬টি চেক থাকা সত্ত্বেও ৩ কোটি ২৫লাখ টাকার মামলা না করে ১টি চেকে ১ কোটি টাকার মামলা করার রহস্য কি? আদৌ কি বাদীনির কাছে ৬টি চেক ছিলো? তাছাড়া ২০১৬ সালে দেয়া চেক ২০২২ সালে এসে কেন মামলা করলেন?

আরিফুল ইসলাম জিয়ার সাথে ১০০ টাকার জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে যে অঙ্গিকারনামার কথা বাদীনি তার মামলায় উল্লেখ করেছেন ওই অঙ্গিকার নামার স্বাক্ষর দলিল লেখক সালাহ উদ্দিনের নয় বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, এধরনের কোন ঘটনা আমার অফিসে ঘটেনি। ওই স্ট্যম্পের স্বাক্ষর আমার নয়, এটা কেউ নকল করেছে। আমি আদালতে আবেদন করেছি, স্বাক্ষর এক্সপার্টে দেয়ার জন্য। আশা করি ন্যায় বিচার পাবো।

এবিষয়ে মামলার ২নং আসামী আরিফুল ইসলাম জিয়ার মুঠোফোনে বার ফোন দেয়ার পরও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার মতামত নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে মামলার অপর আসামী শাহআলম জানান, এই মামলাটি একটি মিথ্যে মামলা। এ বিষয় তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় এগোতে চাইছেন বলে জানান।

মূল ঘটনা: বাদীনি নুরজহান বেগম কুলটেক সলিউশন লিমিটেড কোম্পানীর নিকট ২৫৮ শতক ভুমি ৩কোটি ৭৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। ওই সময় ১৭৮ শতক ভুমি দলিল করে দেন এবং ৮০ শতক ভূমি বায়না করা হয়। এর বাবদ বাদীনি নুরজাহান বেগম আরিফুল ইসলাম জিয়ার কাছ থেকে ২কোটি ৭৫ লাখ টাকা নগদ ‍বুঝে নেন। বাকী ৮০ শতক ভুমি বাবদ আরিফুল ইসলাম জিয়া কোম্পানীর পক্ষে নিজ নামের ৬টি চেক হস্তান্তর করেন। ২০২১সালে ওই ৮০ শতক ভূমি দলিল নেয়ার কথা থাকলে ওই সময় ৮০ শতকের মধ্যে ৪৭ শতক দলিল হওয়ায় নগদ ৫০ লাখ টাকা বাদীনি নুরজাহান বেগমকে আরিফুল ইসলাম জিয়া নগদ বুঝিয়ে দিয়ে ৬টি চেক ফেরত নেন এবং বাকি ৩৩ শতক দলিল দিয়ে ৫০লাখ টাকা নেয়ার কথা বলা হয়। ওই সময় বাকি ৩৩শতকের জন্য আরিফুল ইসলাম জিয়া আরও ৫০ লাখ টাকার আরেকটি ব্ল্যাক চেক দেন। দলিল না হওয়ায় বাদীনি ও তার ছেলেরা টাকা না পেয়ে নিয়মিত জিয়াকে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। তাদের ভয়ে আরিফুল ইসলাম জিয়া ওই এলাকায় আসতে পারেনি। পরবর্তীতে বাদীনি ওই চেকে ১কোটি টাকা বসিয়ে একটি চেক ডিজঅনার মামলা এবং অপরটি ৩কোটি ৪০ লাখ টাকা চেয়ে চারজনের নামে মামলা দায়ের করেন। আর এই মামলার ভয় দেখিয়ে কোম্পানীর সাথে আপোষের নামে ১কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। বাকী আসামীদের সাথেও আপোষের নামে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে বলে উভিযোগ রয়েছে।